বিকল্প/প্রাচীন ঐতিহ্যগত ওষুধপত্র
আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতি হলো এলোপ্যাথি। একে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিও (Modern system of medicine) বলা হয় ৷ অন্য যে পদ্ধতি গুলো এখানে আছে এবং অনেক মানুষ এসব পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকে সেগুলো হলো:
(ক) আয়ুর্বেদিক (Ayurvedic)
(খ) মঘা (Mogha)
(গ) ইউনানী (Unani)
(ঘ) হোমিওপ্যাথি (Homeopathy)
(ঙ) বায়োকেমিক (Biochemic)
(চ) আকুপাংচার (Acupuncture)
(ছ) আকুপ্রেসার (Acupressure)
(জ) ন্যাচারোপ্যাথি (Naturopathy)
(ঝ) এরোমা থেরাপি (Aromatherapy)
(ঞ) গার্হস্থ্য চিকিৎসা (Home remedy)
ইত্যাদি
আধুনিক চিকিৎসার বিপরীতে সবগুলোই লোকজ চিকিৎসা বা বিকল্প চিকিৎসা নামে পরিচিত ৷ এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত ওষুধ কে বিকল্প বা প্রাচীন ঐতিহ্যগত ওষুধ বলে। আয়ুর্বেদ আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা। ‘আয়ু’ মানে ‘জীবন’ ও ‘বেদ’ মানে ‘জ্ঞান’। সম্ভবত আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে এদেশে এর প্রচলন হয়। আয়ুর্বেদ স্বাস্থ্যের উৎপত্তি যেখান থেকে সেই বইটির নাম ‘ঋগ্বেদ’।
পরবর্তীতে খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় ৮০০ বছর আগে এদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী চরক লিখিত ‘চরক সংহিতা’ এবং খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে এদেশের আরেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী সুশ্রুত লিখিত ‘সুশ্রুত সংহিতা’ বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আরো অনেক বিজ্ঞানী আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কে উন্নত করেন। মোগল সম্রাটদের রাজত্বকালের আগে পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসারই প্রচলন ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের সাথে সাথে মঘা চিকিৎসা পদ্ধতি বিকশিত হতে থাকে। কথিত আছে যে এক মাঘী পূর্ণিমার রাতে এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্বোধন করেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী জীবক। আয়ুর্বেদ থেকে উদ্ভব হওয়ার ফলে আয়ুর্বেদিক ও মঘা চিকিৎসা পদ্ধতি প্রায় একই ধরনের। পার্থক্য শুধু এই যে আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতে ওষুধের উৎস উদ্ভিদ, মঘা পদ্ধতিতে ওষুধের উৎস শুধুমাত্র উদ্ভিজ ও খনিজ৷ প্রাণী হত্যা বৌদ্ধ ধর্মে অনুমোদিত নয় বলে কোন প্রাণীজ ওষুধ এই শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় না৷
মোগল শাসকরা মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তান হয়ে এদেশে আসেন। তাদের সাথে ছিল সেই এলাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা, যার নাম ইউনানী। এর আদি জন্মস্থান গ্রিসের ইউনান বা হুনান প্রদেশ। সেখান থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে এই চিকিৎসা পদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্যে আসে। ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের পর আল-রাজি, ইবনে সিনা প্রমুখ বিখ্যাত চিকিৎসকেরা ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতিকে অনেক উন্নত করেন। ভারতবর্ষেও মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইংরেজরা যখন এ দেশে শাসন পরিচালনা করতে থাকে, তখন তারা তাদের সাথে আসা চিকিৎসকদের মাধ্যমে এ দেশে এলোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচলন করে। দীর্ঘ ইংরেজ শাসনামলে ইউরোপে এই পদ্ধতির বৈপ্লবিক উন্নতি ঘটে এবং ভারতবর্ষেও তারা এই জ্ঞান প্রসারিত করে। ফলে ধীরে ধীরে মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে ওঠে। এভাবে এলোপ্যাথি চিকিৎসা এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ইংরেজ শাসনামলের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে জার্মানিতে ডাক্তার হানিম্যান হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন৷ এলোপ্যাথি দামি ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বদলে একটি নিরাপদ ও সস্তা চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এই পদ্ধতিও একসময় ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এবং জনপ্রিয়তা পায়।
বায়োকেমিক ওষুধ প্রায় একই সময়ে জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়। এর মূল কথা হলো অল্প কিছু রাসায়নিক উপাদান দিয়ে মানব শরীরের বহু রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব৷ এদের মতে বায়োকেমিক ওষুধ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত ৷ এখন অবশ্য আলাদা করে আর বায়োকেমিক পদ্ধতি দেখা যায় না। এগুলো হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির সাথে একীভূত হয়ে গেছে।
পদ্ধতি আলাদা হলেও এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, মঘা, ইউনানী এবং হোমিওপ্যাথির ওষুধের উৎস একই। মঘা ও ইউনানী শাস্ত্র যেখানে গাছ-গাছড়ার ওপর নির্ভরশীল, এলোপ্যাথি সেখানে গাছ-গাছড়ার মূল ওষুধি উপাদানটিকে সনাক্ত করে, সেটি দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে শুরু করে ৷ অবশ্য বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং গাছ-গাছালি কমে যাওয়ার কারণে গাছ-গাছড়ার মূল উপাদান গুলোকে কৃত্রিমভাবে বা সিন্থেসিসের মাধ্যমে শিল্প কারখানায় তৈরি করা হয়। ফলে বিপুল পরিমাণে ওষুধ উৎপাদনে এলোপ্যাথির জুড়ী নেই।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য প্রায় একই গাছ-গাছড়া ব্যবহার করে তবে অন্য পদ্ধতির তুলনায় তাদের বেশি গাছের দরকার হয় না, কারণ তারা গাছের নির্যাস অ্যালকোহলে মিশিয়ে সেখান থেকে পাতলাকরণ বা Dilution-এর মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে। হোমিও শাস্ত্র মতে, যত ডাইলুশন হবে ওষুধের শক্তিও ততই বেড়ে যাবে। এর ফলে হোমিও ওষুধের দাম অন্য সব পূর্বোক্ত পদ্ধতির তুলনায় সবচেয়ে কম রাখা সম্ভব। আর এ কারণেই এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও কম ৷ যদিও একেবারে নেই তা সত্য নয় ৷ হোমিও ওষুধ নির্বাচনে ভুল হলে এবং শক্তি বা মাত্রা নির্বাচনে ভুল হলে মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে ৷
আকুপাংচার শরীরের বিভিন্ন স্নায়ুতে সুচ ফোটানোর মাধ্যমে চিকিৎসার পদ্ধতি। প্রায় তিন হাজার বছর আগে চিনারা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। বর্তমানেও অনেক জটিল রোগ সারাতে এই পদ্ধতি পৃথিবীর দেশের দেশে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক কালে সুঁই এর সাথে মৃদু বৈদ্যুতিক আবেশে তৈরি করা হয়৷
আকুপ্রেশার পদ্ধতিতে শরীরে বিভিন্ন অংশে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। শরীরের বিভিন্ন ব্যথাযুক্ত স্থানে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে উপশমের পদ্ধতি আমরা সবাই জানি। মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা, হাত-পায়ের পেশীতে ব্যথা, ইত্যাদিতে সেই জায়গাগুলো টিপে দিলে আমরা আরাম পাই। আকুপ্রেশার এগুলোরই একটি উন্নত সংস্করণ। শরীরের নির্দিষ্ট অংশে নির্দিষ্ট নিয়মে নিয়মিত চাপ প্রয়োগে ওষুধ ছাড়াই বেশ কিছু অসুখ ভালো হওয়ার বিষয়টি এখন অনেক বিজ্ঞানীরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে৷
ন্যাচারোপ্যাথি পদ্ধতিতে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করা হয়। রোগীকে তার অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ফলে তার জীবন-যাপন প্রণালী, খাদ্যাভ্যাস, মনের সতেজতা ইত্যাদির পরিবর্তনের মাধ্যমে কোন কোন রোগকে আরোগ্য করা সম্ভব। পুরনো গল্প উপন্যাসে আমরা ওষুধ ও পথ্যের পাশাপাশি রোগীর হাওয়া বদল, বায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি অনুষঙ্গের কথা জানতে পারি৷ শহরের যান্ত্রিক জীবনে আমরা যখন হাপিয়ে উঠি, তখন গ্রামে গেলে আমাদের মন প্রফুল্ল হয়, নদীর বুকে ভ্রমণ কালে আমাদের ক্ষুধা বেড়ে যায়, পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আমাদের ঘুম ভালো হয় ইত্যাদি সবই ন্যাচারোপ্যাথির উদাহরণ৷
এরোমাথেরাপি পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক সুগন্ধ ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করা হয়। যেমন ফুলের গন্ধ আমাদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু এগুলোর মধ্যেও কিছু ঔষুধীগুণ আছে। গোলাপের গন্ধে আমাদের মন প্রফুল্ল হয়, বেলির গন্ধ ঘুমের আবেশ তৈরি করে, হাসনাহেনার গন্ধ মনের উত্তেজনা বাড়ায় বলে সহজে ঘুম আসেনা, কনকচাঁপার গন্ধ মনের উত্তেজনা কমায় ইত্যাদি। আধুনিককালে তাই এরোমাথেরাপি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রচুর আগ্ৰহ সৃস্টি হয়েছে। গার্হস্থ্য চিকিৎসা বলতে ঘরে যেসব প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে আমরা সাধারণ অসুখের চিকিৎসা করি তাকে বুঝায়। ঠান্ডা লাগলে লেবু-আদা সহযোগে চা, পেটের অসুখে থানকুনি পাতার রস, ছোট কৃমির আক্রমণে কচি আনারস পাতার রস, ছোটদের কাশিতে তুলসী পাতার রস, বড়দের কাশিতে বাসক পাতার রস, শরীরের জ্বলুনিতে ধানে ভেজানো পানি বা ডাবের পানি, চুলকানিতে নিমের তেল, খুশকি হলে আমলকির রস ইত্যাদি অসংখ প্রাকৃতিক উপাদান আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি। এসব আমরা শিখেছি আমাদের মুরব্বিদের কাছ থেকে বংশ পরম্পরায়। এজন্য কোনো ডাক্তার -কবিরাজের পরামর্শে প্রয়োজন হয় না, ঔষধ কেনার জন্য কোনো টাকাও খরচ করতে হয় না। ঘরে ঘরে বিরাজমান এই চিকিৎসা-জ্ঞান আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। গার্হস্থ্য চিকিৎসা আমরা তাই উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের আগের প্রজন্মের কাছ থেকে শিখে নেই এবং ব্যবহার করি। পৃথিবীর সব দেশেই এরকম গার্হস্থ্য চিকিৎসা কম বেশি প্রচলিত। এলোপ্যাথি ঔষুধের পাশাপাশি, আয়ুর্বেদ, মঘা, ইউনানী ইত্যাদি পদ্ধতিগুলোর কার্যকারণ সূত্র বিজ্ঞানীদরে জানা। নেচারোপ্যাথি ও গার্হস্থ্য চিকিৎসা কার্যকারণ সূত্র বিষয়েও বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা দিতে পারছেন। কিন্তু হোমিওপ্যাথি, বায়োকেমিক, আকুপাংচার, আকুপ্রেসারে ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ঠিক কিভাবে কাজ করে তা এখনো অজানা হলেও এগুলো যে অনেক অসুখে ফলপ্রদ তা প্রমাণিত। বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ যা অজানা, হয়তো কিছুদিন পর বিজ্ঞান যখন আরো উন্নত হবে তখন সেগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তরও বিজ্ঞান একসময় দিতে পারবে। সে কারণে সব ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিকল্পিত ব্যবহার আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত সহায়ক হবে। তবে লোকজ ঔষধ নিয়ে আমাদের দেশে কোনো কোনো মহলের কিছু বাণিজ্য অপকৌশলও প্রচলিত রয়েছে। তারা বলে থাকে লোকজ ঔষধ সব ধরণের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ামুক্ত। কিন্তু এই প্রচারটি সত্য নয়। সব ঔষধেরই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে, লোকজ ঔষধও সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে এটি ভালো করতে গিয়ে খারপ করবে। এই ধরণের খারাপ ফলাফলের প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। তাই লোকজ ঔষুধকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ও এই মহলটি প্রচার করে থাকে যে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, হৃদরোগ, জন্ডিস ইত্যাদি লোকজ ঔষধের মাধ্যমে গ্যারান্টিসহকারে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু এগুলো অপপ্রচার মাত্র এবং অপপ্রচারের শিকার হয়ে কেউ এগুলো ব্যবহার করলে অসুখ ভালো না হয়ে আরো খারাপের দিকে যায় এবং শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হয়। এসব অসুখের কোনোটিই গ্যারান্টি দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, এ সত্য সবাইকে বুঝতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার করা হয় যৌন রোগ নিয়ে। যৌন সমস্যা অন্যান্য অসুখের মতোই এবং ভালো ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করালে অসুখ ভালো হতে বাধ্য। কিন্তু মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে এই মহলটি প্রচুর টাকা অন্যায়ভাবে রোজগার করছে এবং যৌনরোগকে ভালো না করে বরং আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এরা তাদের ঔষুধে যৌন উত্তেজক বিভিন্ন এলোপ্যাথি উপাদান কিংবা ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করছে, যার ফলে রোগী সাময়িক উপকার পেলেও তার যৌনজীবন ক্রমাগত খারাপের দিকে চোলে যেতে থাকে এবং শরীরে অন্যান্য দুরারোগ্য অসুখ দেখা দেয়। ফলে রোগী শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে চরম হতশায় নিমজ্জিত হয়। তাই এসব অপপ্রচারের হাত থেকে রোগীকে দূরে রাখা ফার্মাসিস্টের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব। লোকজ ঔষধের ভালো দিকগুলো আমরা গ্রহণ করবো, কিন্তু খারাপ দিকগুলো থেকে দূরে থাকবো। রোগী যেন নিজে নিজে পছন্দ করে কোনো লোকজ ঔষুধ ব্যবহার না করে সে বিষয়ে তাকে সচেতন করতে হবে। ভালো লোকজ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মাসিস্টও কোনো লোকজ ঔষধ রোগীকে ব্যবহার করতে পরামর্শ দেবে না। কারণ নিজের ডাক্তারি নিজে করতে গিয়ে রোগী তার শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করবে। আর হাতুড়ে বা লোকজ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনেও তার একই রকম ক্ষতি হতে বাধ্য।লোকজ চিকিৎসাকে অবহেলা না করে আমরা তাকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের পক্ষপাতী। কারণ এলোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থা আধুনিক ও অত্যন্ত কার্যকর হলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শুধুমাত্র এলোপ্যাথি দিয়ে ১০০% জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এর কারণ এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে ১০০% জনগণকে শুধুমাত্র এলোপ্যাথি দিয়ে চিকিৎসা করতে যে বিপুল পরিমান টাকা প্রয়োজন হবে ( দেশের আনাচে-কানাচে হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, রোগ-নির্ণয় যন্ত্রপাতী, ঔষুধ ইত্যাদি বাবদ ) সে পরিমান বিপুল টাকা কোনো সরকারের পক্ষেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা সম্ভব নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সে কারণেই ১৯৭৬ সালে থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সব জনগণকে সরকারী-বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে এলোপ্যাথির পাশাপাশি লোকজ চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোকেও ব্যবহারের জন্যেও জোর সুপারিশ করে আসছে। সংস্থা বলছে লোকজ চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নয় বরং এর চিকিৎসা গুনগুলোকে ব্যবহার করে জাতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া লোকজ চিকিৎসাতে ভালো হয় এমন ঔষধ এবং এগুলোর জন্য যেসব ঔষধ বা গাছগাছড়া ব্যবহৃত হয় তার তালিকা প্রণয়নের জন্য স্বল্পোন্নত দেশের সরকারগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে। এই আলোকে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও তার শত বছরের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোকে সংগঠিত করেত বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচিনী ইশতেহারে লোকজ ঔষধ বা বিকল্প ঔষধের আরো উন্নয়ন করে এলোপ্যাথি ঔষধের পরিপূরক হিসাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। হাজার বছর ধরে যে লোকজ ঔষধ এদেশের মানুষ ব্যবহার করে আসছে তার উন্নয়ন করা সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ। ভূ -প্রকৃতি ও জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ লোকজ ঔষধের গাছগাছড়ায় অত্যন্ত সম্মৃদ্ধ। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এদেশের ইউনানি , আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি ঔষধের বিকাশে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে।
লোকজ চিকিৎসাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করতে হলে শুধু লোকজ ঔষধ তৈরির কারখানা বসালেই হবে না, প্রচুর পরিমাণ শিক্ষিত কবিরাজ-হাকিম-হোমিও ডাক্তারও প্রয়োজন। সরকার তাই ইতোমধ্যে লোকজ চিকিৎসক তৈরির উপযুক্ত পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন। আমাদের দেশে এখন লোকজ চিকিৎসা শিক্ষার দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর একটির নাম ‘ সরকারি ইউনানি ও আয়োর্বেদ মেডিকেল কলেজ ‘ এবং অন্যটি ‘সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ । এগুলো ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। বিজ্ঞান গ্ৰুপে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এগুলোতে ভর্তি হতে হয়। এর প্রতিটিতেই ১০০- শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালও রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখানে লোকজ চিকিৎসার ৫- বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্স অধ্যয়ন শেষে ১ বছর ধরে ইন্টার্নি হিসাবে অভিজ্ঞতা লাভের পর স্নাতক ডিগ্রি পেয়ে থাকে।
ইউনানির জন্য এই ডিগ্রির নাম ‘ব্যাচেলর অব ইউনানি মেডিসিন এন্ড সার্জারি বা বি ইউ এম এস’, আয়ুর্বেদের জন্য ‘ ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি বা বি এ এম এস’ এবং হোমিওপ্যাথির জন্য ‘ ব্যাচেলর অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি বা বি এইচ এম এস’। এছাড়া বাংলাদেশে ১১টি ইউনানি ডিপ্লোমা কলেজ, ৭টি আয়ুর্বেদ ডিপ্লোমা কলেজ এবং ৩৮টি হোমিওপ্যাথিক ডিপ্লোমা কলেজ রয়েছে। এগুলোতে মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হতে হয় এবং ৪ বছরের কোর্স ও ৬ মাসের ইন্টার্নি করার পর তারা ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট লাভ করে। এগুলোর নাম যথাক্রমে ‘ডিপ্লোমা ইন ইউনানি মেডিসিন এন্ড সার্জারি বা ডি ইউ এম এস’, ‘ ডিপ্লোমা ইন আয়ুর্বেদিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি বা ডি এ এম এস’ এবং ‘ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি বা ডি এইচ এম এস’।
এছাড়াও সরকার জেলা হাসপাতালগুলোতে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি লোকজ চিকিৎসা সেবা দেয়ার লক্ষে এ পর্যন্ত অতিরিক্ত ১৯৮টি মেডিকেল অফিসারের পদ সৃষ্টি করে সেখানে ৬৬ জন ইউনানি, ৬৬ জন আয়ুর্বেদ এবং ৬৬ জন হোমিওপ্যাথিতে উপযুক্ত স্নাতক ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দিয়েছেন। বর্তমানে এই লোকজ চিকিৎসকরা সব জেলা হাসপাতালগুলোতে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, এই লোকজ চিকিৎসকদের সাহায্য করার জন্য সরকার ৬৪জন সহকারী (বা কম্পাউন্ডার) নিয়োগ দিয়েছেন।
জনগণের মধ্যে ঔষুধি গাছের চিকিৎসা-গুণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার সারা দেশে ৪৬৭টি প্রদর্শনী বাগান প্রতিষ্টা করেছেন। এখন প্রতিটি জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এরকম ঔষুধি গাছের বাগান রয়েছে। এসব বাগানের উপযুক্ত পরিচর্যার জন্য উপরোক্ত প্রতিটি বাগানে একজন করে মালি (হার্বাল এসিস্টেন্ট) নিয়োজিত রয়েছে। উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের ফলে দেশব্যপী বিপুল সংখ্যক রোগী অন্ধ বিশ্বাসের মাধ্যমে নয় বরং বৈজ্ঞানিক মতে লোকজ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। কিছুদিন আগে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা মোট রোগীদের মধ্যে ২৮% রোগী লোকজ চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। এই পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত আশাপ্রদ। সরকার তাই পর্যায়ক্রমে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কমপক্ষে ১ জন করে মেডিকেল অফিসারের পদ সৃস্টি করে লোকজ চিকিৎসাকে জনগণের আরো কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা নেটওয়ার্ক ছাড়াও সারা দেশে অনেক লোকজ-চিকিৎসা স্নাতক এবং ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক বিভিন্ন বেসরকারী সেবা সংস্থা (এন.জি.ও) কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আসা করা যায় ভবিষ্যতে এই সেবা খাতগুলো আরো বিকশিত হবে। সরকারের এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে একদিকে যেমন এলোপ্যাথি ঔষুদের উপর থেকে চাপ কমবে ও জনগণ লোকজ চিকিৎসা থেকে প্রভূত উপকার পেতে পারবে, তেমনি লোকজ চিকিৎসা নিয়ে অন্যায়-মুনাফালোভী ও সুযোগ সন্ধানী মহল অপপ্রচারের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ব্যর্থ হবে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থারো উম্নতি ঘটবে।
সূত্র: বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত বই থেকে।
